৭টি কোড যা কখনো ভাঙা যায়নি
কোড এর মাধ্যমে অনেক আগে থেকেই গোপন যোগাযোগ করে আসছে মানুষ। কোনো একটি কোড ভাঙতে পারলে কিছু গুপ্ত তথ্য জানা যায় আবার কখনো কখনো বড়সড় রহস্যের সমাধানও হয়ে যায়। কিন্তু পৃথিবীতে এমন কিছু কোড আছে যা কেউ ভাঙতে পারেনি এখন পর্যন্ত। সিআইএ, এনএসএ, কেজিবি এর মতো গোয়েন্দা সংগঠনগু্লোর ক্রিপ্টোগ্রাফিস্টরা হাজার হাজার জটিল ও রহস্যময় কোড এর মর্ম উদ্ধার করতে পারলেও কিছু কোডের মানে এখনো বুঝতে পারেনি।
এসব কারণে কোড এবং সাইফারের বিষয়গুলো মানুষের কাছে আরো কৌতূহলদ্দীপক হয়ে উঠে। নিচে এমন কিছু কোড এর বর্ণনা করা হলো যেগুলো কেউ কখনো ভাঙতে পারেনি।
১.ভয়নেচ পান্ডুলিপি (দ্য ভয়নেচ ম্যানুস্ক্রিপ্ট):

ভয়নেচ পান্ডুলিপি হলো ইতিহাসের অদ্ভুত পান্ডুলিপিগুলোর একটি। আনুমানিক ১৫-১৬ শতকে এটি লেখা হয়। এমন একটি ভাষায় এটি লেখা হয়েছে যা কেউ বোঝেনা, এর বিষয়বস্তুও কেউ বোঝেনা এবং এতে যেসব গাছপালার ছবি আঁকা আছে বাস্তবে এরকম গাছপালা কোথাও পাওয়া যায়না। এছাড়াও এখানে যোডিয়াক চিহ্ন, জ্যোতীষবিদ্যা এর চার্ট, ঔষুধি গাছের ছবি এবং উলঙ্গ মহিলার গোসল করার চিত্রও পাওয়া গেছে। এই পান্ডুলিপির ২৪৬ টি চামড়ার পৃষ্ঠা খুব সম্ভবত মধ্যযুগীয় আলকেমি এর প্রতি ইঙ্গিত করে। কিন্তু কেউই স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারেনা।
শুধু এইটুকুই জানা যায় এটি একটি স্বতন্ত্র ভাষায় রচিত এবং এর প্যাটার্নও অনন্য। এর বর্ণমালায় ১৬- ২৮ টি অক্ষর রয়েছে যা ল্যাটিন এবং গ্রীক ভাষার সাথে কিছুটা সামঞ্জস্যপূর্ণ। পান্ডুলিপিটি বাম থেকে ডান দিকে লেখা, এর শব্দসংখ্যা ১৭০,০০০ এবং এতে কোনো জ্যোতিচিহ্ন নেই।
২০ শতকের একজন বিখ্যাত ক্রিপ্টগ্রাফার উইলিয়াম ফ্রেইডম্যান এর কোনো মর্ম উদ্ধার করতে পারেননি এবং তিনি সন্দেহ করেন এটি একটি কৃত্রিম বানানো ভাষা। জার্মান কম্পিউটার বিজ্ঞানীর ক্লাউস স্কেমেহ এর মত অনুসারে এটি এক ধরণের প্রতারণা এবং এর মূল ভাষা- “অর্থহীন ফিলার টেক্সট” এ লেখা আছে। কিন্তু এসব ঝামেলা থেকে উক্ত পাঠ উদ্ধার করার কোনো পদ্ধতি নেই। ভাষাবিদ এবং কম্পিউটার বিজ্ঞানী গরডন রাগ উক্ত পান্ডুলিপিকে একধরনের প্রতারণা হিসেবেই আখ্যায়িত করেছেন।
২. দ্য বিয়েল সাইফারস (১৮৮৫)

নাইট এর ব্যাখ্যা অনুসারে, “এই সাইফার এর পাঠোদ্ধার করতে পারলে রাশি রাশি স্বর্ণ পাওয়া যাবে।” …… রাশি রাশি স্বর্ণের ব্যাপারটা সত্য, যদি না পুরো সাইফারটিই মিথ্যা প্রতারণা হয়।
১৮৮৫ সালেদ্য বিয়েল পেপারস নামক একটি পুস্তিকার সাথে এই সাইফারটি প্রকাশিত হয়। স্বর্ণের গাদার ঘটনাটি সত্য নাকি মিথ্যা এই নিয়ে ক্রিপ্টোগ্রাফিস্টরা অনেক ধোঁকা খেয়েছেন। এই পুস্তিকায়
মাটিতে পুঁতে রাখা ধনের স্তূপ নিয়ে একটি অসাধারণ গল্প আছে। এই গল্প অনুসারে থমাস জেফারসন বিয়েল নামক এক ব্যক্তি (যার অস্তিত্ব ছিল কিনা তা নিয়েই অনেক সন্দেহ) এই স্বর্ণ খুঁজে পেয়েছিলেন।
স্বর্ণের সিক্রেটটা মোট তিনটি ক্রিপ্টোগ্রাম দ্বারা গোপন রয়েছে যার একটি প্রকাশ হয়ে গেছে। কিন্তু প্রকাশিত এই একটি ক্রিপ্টোগ্রামে শুধু ব্যাখ্যা করা হয়েছে কীরকম গুপ্তধন রয়েছে মাটির নিচে সেই ব্যাপারে। আর গুপ্তধনের স্থান হিসেবে বেডফোর্ড কাউন্টির নির্দিষ্ট কোনো জায়গার প্রতি ইঙ্গিত করাও হয়নি।
নির্দিষ্ট স্থানের ব্যাখ্যা হয়তো পাওয়া যাবে যদি অন্য দুইটি ক্রিপ্টোগ্রাম উদ্ধার করা হয়। তবে এর পাঠোদ্ধার করতে হলে ইতিহাস ঘাটাঘাটি করতে হবে। ধারণা করা হয়- ক্রিপ্টোগ্রামের যেগুলো এখনো ডিক্রিপ্টেড রয়েছে তা স্বাধীনতার ঘোষণাবাণীর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যেমন- উক্ত পান্ডুলিপির ১১৫ দিয়ে বোঝানো হয়েছে স্বাধীনতার ঘোষণা বাণির ১১৫ তম শব্দের প্রথম অক্ষর- instituted অর্থাৎ i. তাহলে অপর দুই সাইফার অনুবাদ করার জন্য কোন ইতিহাস খুঁজতে হবে তা কেউই জানেনা। এছাড়াও এই নিয়ে অনেক সন্দেহ আছে যে আসলেই কি ক্রিপ্টোগ্রামের লেখক বুদ্ধিজীবী ছিলেন কিনা নাকি অহেতুক নিজের মতো করে একটি কোড তৈরী করে রেখেছেন।
৩.ডরাবেলা (১৮৯৭)

১৮৯৭ সালে ৪০ বছর বয়সি এক সুরকার এডওয়ার্ড এলগার তার এক বন্ধুর নাতনি এর কাছে কোড আকারে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। মেয়েটির নাম ছিল ডোরা পেনি এবং বয়স ছিল ২৩ বছর। নাইট এর বক্তব্য অনুসারে, “৪০ বছর বয়সি একজন তার অর্ধেক বয়সের কোনো মেয়ের কাছে কোড আকারে কী এমন লিখতে পারে?”
সাইফারটির আকার অনেক ছোট। নাইট ব্যাখ্যা করেন, “ছোট সাইফারগুলো ভাঙতেও অনেক কষ্ট।” বড় কোনো সাইফারে দেখা যায় q এবং u এই দুইটি অক্ষরই কয়েকবার করে আছে। তাই এগুলো মিলানোও সহজ। কিন্তু ছোট সাইফারগুলোতে দেখা যায় কোনো অক্ষর একবারও না থাকতে পারে, তাই কমন ধরে মেলানোটা অনেক কষ্টকর।
অন্য এক মতানুসারে এটি একধরণের স্বতন্ত্র ভাষা যা কেবল এলগার এবং ডোরা পেনিই বুঝতে পারত। যদি এই মতবাদ সত্যি হয় তাহলে আসলে এই সাইফার ভাঙা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এটি কেবল ঐ দুইজনই বুঝতে পারবে।
৪. তামান শুড (১৯৪৮)

কোনো মৃত ব্যক্তির পকেটে যদি এরকম একটা সাইফার পাওয়া যায় তাহলে তা আরো কৌতূহলদ্দীপক হয়ে উঠে। ১৯৪৮ সালের ১লা ডিসেম্বর অষ্ট্রেলিয়ার এডেলেইডের সমুদ্রতীরে একজন মৃত ব্যক্তিকে পাওয়া যায় পরিচয় জানা যায়নি কিন্তু তিনি ‘সমরাটন ম্যান’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি কীভাবে মারা গিয়েছিলেন তার কোনো চিহ্নও পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয় তিনি কোনো অনির্ণেয় বিষ খেয়ে মারা গেছেন। অথবা কোনো এক সোভিয়েত খুনী তাকে হত্যা করেছিল।
কিন্তু বিষয়টা আরো অদ্ভুত হয়ে যায় যখন তার পকেটে একটি ছেড়া কাগজ পাওয়া যায় যাতে লেখা ছিল “তামান শুড” যার পার্সিয়ান অর্থ হলো “শেষ”। পরে ধরা পড়ে যে এটি ওমর খৈয়াম এর রুবাইয়্যাত এর কপির একটি অংশ। বইটি খুনের আশেপাশে একটি স্থানের গাড়ির ব্যাক-সিটে পাওয়া যায় এবং ধারণা করা হয় লোকটি ঐ জায়গাতে গিয়েছিল মারা যাওয়ার আগে। বইয়ের পিছনের দিকে পেন্সিলে লেখা ৫ লাইনের একটি কোড পাওয়া যায়। নাইট ব্যাখ্যা করেন, “এটি ছোট একটি কোড এবং অনেক কৌশলী যা বিশ্লেষণ করে বের করাটা দুঃসাধ্য। যদিও মনে হতে পারে এটি ওমর খৈয়ামের রুবাইয়্যাত বইটির সাথেই সম্পর্কিত।”
৫.দ্য যোডিয়াক কিলার সাইফার (১৯৬৯)

১৯৬০ এবং ১৯৭০ এর প্রথম দিকে উত্তর ক্যালিফর্নিয়ায় আক্রমণ চালায় এক সিরিয়াল কিলার। সে ২ টি কিপ্টোগ্রাম রেখে গিয়েছিল; এর মধ্যে ৪০৮ অক্ষরের কোড কিছুদিনের মধ্যেই ভাঙতে সক্ষম হয়; বাকি ৩৪০-অক্ষরের কোডটি এখনো রহস্যই রয়ে গেছে। এই সিরিয়াল কিলারকে কখনো ধরা যায়নি।
“টেলিভিশনে সিরিয়াল কিলাররা সাধারণত ভুল করে এবং ধরা পড়ে যায়,” নাইট বলে। “কিন্তু এ ধরা পড়েনি, তাই একে নিয়ে কৌতূহল রয়েছে জনমনে।”
কোডটির পাঠোদ্ধার করা কতটা কঠিন তার জন্য সম্ভাব্য কম্বিনেশন বিবেচনা করা যাক। এখানে দেখা যাচ্ছে ৬৩ টি চিহ্নের মোট ৩৪০ টি অক্ষর, কিন্তু আমরা জানিইনা এগুলো দিয়ে কী বোঝানো হয়। এগুলো কি কোনো বর্ণমালার অক্ষর? এগুলোর মধ্যে কোনোগুলো কি বিরাম চিহ্ন বা সংখ্যা বোঝাচ্ছে? অথবা পুরো একটা শব্দ? ধরা যাক প্রতিটি চিহ্ন একটি অক্ষর নির্দেশ করছে। তাহলে এর সমধান সংখ্যা হবে ২৬^৬৩= ১৩৯০৯৮০১১৭১০৭৪২১৯৫৫৯০৯৭৪২৫৯০৯৪৭৯৫৪০৩৮৪২৬৫৫৮৪২১৪২৪৯০৩৩০৫১৮৭১৬৭২৭৪০৩৩৩৩৪৭৪৬৭২৭ টি।
তো এখন যা করা যায় তা হলো এই সিরিয়াল কিলারের আগের ক্র্যাক করা আরেকটি ক্রিপ্টোগ্রামের সহায়তা নিয়ে এটা ভাঙার চেষ্টা করতে পারি,যেমন- Z408 cipher. তবে নাইটের মতে এই কোডটি আগেরটির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না।
৬.ক্রিপ্টোস (১৯৯০)

Photo Source: Leaksource.wordpress.com
নাইট বলেন, “আপনি যদি CIA এর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চান তাহলে এই কোডটি ভেঙে দেখান।” ল্যাংলিতে অবস্থিত সিআইএ এর হেডকোয়ার্টারের গ্রাউন্ড ফ্লোরে অবস্থিত “ক্রিপ্টোস” নামের এই ভাষ্কর্যটি তৈরী করেন জিম স্যানবর্ন। এটি তৈরীর সময় সিআইএ এর ক্রিপ্টোগ্রাফার এড স্কেডিট এর সাহায্য নেন জিম স্যানবর্ন। এই সাইফারটির মোট অক্ষর সংখ্যা ৮৬৯ টি এবং এর ৪টি ভাগ রয়েছে। এর মধ্যে তিনটিরই সমাধান হয়ে গেছে (সিআইএ এর সদস্যদের সমাধানের জন্য ৭ বছর লেগে গেছে)। ৪র্থ শ্রেণিতে মোট অক্ষর সংখ্যা ৯৭ টি, একে k4 হিসেবে ডাকা হয়। এটি এখনো রহস্য রয়ে গেছে। স্টিভেন লেভি আবিষ্কার করেন এই কোড লিখতে ব্রায়ান-বার্স্টিং পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে- যেখানে ইচ্ছাকৃত ভুল বানান, মেশানো অক্ষর, জটিল গাণিতিক সূত্র ইত্যাদী ব্যবহার করা হয়েছে।
“K4 সহজ হওয়া উচিত, কারণ এটি অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট সাইফার টাইপ, অথবা স্ট্যান্ডার্ড সাইফার টাইপের সংমিশ্রণ” নাইট বলেন। “কিন্তু হতে পারে এটি বিশেষ একটি পদ্ধতিতে এনকোড করা আছে যা বের করা অনেক কঠিন হবে।”
২০০৩ সাল থেকে ইয়াহু গ্রুপের মাধ্যমে একটি দল এর সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সানবর্ন এর উত্তর জানে এবং সে এখনো বেঁচে আছে। আপনার যদি মনে হয় আপনি সিআইএ এর ওয়েবসাইটে এর সমাধান সাবমিট করতে পারবেন তাহলে ভুল করছেন। কারণ এরকম কোনো ব্যবস্থা নেই সেখানে।
৭. ম্যাককর্মিক (১৯৯৯)
Photo Source: Truecrimegarage.com
একটি খুনের তদন্ত করার জন্য এফবিআই আপনার সাহায্য চাচ্ছে। ১৯৯৯ সালের জুন মাসে, ৪১ বছর বয়সি এক লোকের দেহ আংশিক বিকৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। মানুষটি ছিল বেকার, অক্ষম এবং প্রাক্তন অভিযুক্ত। তার পকেটে দুইটি এনক্রিপ্টেড নোট পাওয়া যায়। চিকিৎসকরা মনে করেন তাকে কেউ খুন করেনি এবং এ-ও জানা যায় যে তিনি বালক বয়স থেকেই কোড লিখতে শুরু করেন। তবে তার শরীরে খুন কিংবা আত্মহত্যার কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি এবং তার অনেক শারীরিক সমস্যা ছিল। তার ৩০ লাইনের এই নোটে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিলনা। তাহলে নোটগুলো কি শেষ কোথায় গিয়েছিল তার বর্ণনা করে? নাকি তার মৃত্যু সম্পর্কে অন্য কোনো তথ্যের ইঙ্গিত করে?
২০১১ সালে এফবিআই ঘোষণা করে ম্যাককর্মিকের মৃত্যুটি খুন হতে পারে এবং তাই তারা নোটগুলো প্রকাশ করে দিয়েছে। ড্যান ওসলন, উক্ত এজেন্সির প্রধান বলেন,
যদি তিনি কোনো প্রেম পত্র বা বাজারের লিস্টও এতে করে থাকেন তবুও আমরা দেখতে চাই কীভাবে এটা সমাধান করা হয়। এটি হয়তো এমন একটি সাইফার পদ্ধতি যার সম্পর্কে আমরা কিছুই জানিনা।”
এফবিআই ইন্টারনেটে জনসাধারণকে এই কোড ভাঙার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। এর রেসপন্স খুবই ভাল ছিল এমনকি এফবিআই এর সমাধানের জন্য একটি ওয়েবসাইট পর্যন্ত খুলে ফেলেছিল। আপনার কী এই নিয়ে কোনো আইডিয়া আছে? তাহলে এফবিআই কে জানান। কিন্তু মনে রাখবেন আপনাকে অনেক তথ্য নিয়ে কাজ করতে হতে পারে। “এফবিআই অনেক বছর ধরেই এর উপর কাজ করে আসছে,” নাইট বলেন। “তাই আপনাকে এমন কিছু দেখতে হবে যা এফবিআই দেখেনা।”
Feature Photo Source: Knowyourmeme.com